ডেস্ক নিউজঃ ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আলোচিত মামলার রায় আজ বৃহস্পতিবার। এ ঘটনায় গণমাধ্যমসহ সারা দেশের মানুষের চোখ এখন আদালতের রায়ের দিকে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিখণ্ডন শেষে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ এ তারিখ নির্ধারণ করেন।
অল্প সময়ের মধ্যে এই মামলার রায় ফেনীর আদালতে একটি বিরল ঘটনা বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। এর আগে ফেনীর আদালতে এত অল্প সময়ের মধ্যে আর কোনো মামলার রায়ের তারিখ নির্ধারণ হয়নি।
ফেনী জজকোর্টের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. হাফেজ আহাম্মদ জানান, ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির কথা বলা হলেও ৬১তম কার্যদিবসে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়।
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ মামলা প্রমাণ করতে পেরেছে। সারা দেশের মানুষ এ চাঞ্চল্যকর মামলার রায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।’ তিনি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করেন।
এদিকে রায়কে কেন্দ্র করে আদালতপাড়ায় পুলিশের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফেনীর পুলিশ সুপার খন্দকার নূরুন্নবী।
তিনি বলেন, ‘শুধু আদালতপাড়া নয়, নুসরাতের বাড়িতেও নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। শহরে কাউকে জড়ো হতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ বিশৃঙ্খলা করতে চায়, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
নুসরাত পরিবারের দাবি, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে, আর আসামিপক্ষের আইনজীবী বলছেন, অভিযুক্তরা ন্যায়বিচার পাবেন।
গতকাল বুধবার বিকেলে নুসরাতের বাড়ি গেলে মা শিরীন আখতার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তার কারণে মামলাটি খুব তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রীসহ বিচার বিভাগের কাছে আমার অনুরোধ-অপরাধীদের ফাঁসি না দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হোক, যাতে করে বুঝতে পারে আগুনের পোড়া যন্ত্রণা কত কষ্টের। আমার মেয়ে রাফি মাংস নিয়ে কবরে যেতে পারেনি। আমার মেয়ে পানি পানি বলে চিৎকার করেছে, কিন্তু খেতে পারেনি। অপরাধীদের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনলে অন্য কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি হবে না।’
এ সময় প্রতিবেশী মো. মোস্তফা বলেন, ‘বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের মতো নানা রকম অপরাধ ঘটলেও সেসব মামলা আলোরমুখ দেখতে সময় লেগে যায় যুগের পর যুগ। কিন্তু নুসরাত হত্যা মামলাটি সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তার কবরটি অক্ষত থাকাবস্থায় মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে। নুসরাত হত্যা মামলার মতো অন্য সব মামলাগুলো যদি এ রকম তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হয়, তাহলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা অনেকাংশেই কমে যাবে। ’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ফেনী জেলার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনেরও একই দাবি-‘অল্প সময়ের মধ্যে আসামিদের আইনের আওতায় এনে সাজার মুখোমুখি করলে অপরাধের মাত্রা কমে যাবে। মামলার কার্যক্রম দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে অন্য অপরাধীরা অপরাধ করতে সুযোগ পায়।’
মামলাসূত্রে জানা যায়, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় গত ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে মারা যান এই আলিম পরীক্ষার্থী।
ঘটনার পর ৮ এপ্রিল আটজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। শুরুতে থানাপুলিশ তদন্ত শুরু করলেও পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) দায়িত্ব পায়।
তদন্তের ৫০ দিনের মাথায় ২৮ মে ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশটি দেওয়া হয়। ৮০৮ পৃষ্ঠার সামগ্রিক নথিতে উল্লেখ করা হয়, কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেয় পাঁচজন। জেল থেকে হত্যার নির্দেশ দেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। আর অর্থ জোগানদাতা হিসেবে উঠে আসে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের নাম।
বাদীপক্ষের আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, ‘সাড়ে ছয় মাসের মাথায় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার রায়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর গত ১০ জুন অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার পর মাত্র ৬১ কার্যদিবসে রায়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনই আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এতে করে সব আসামির অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ।’
অবশ্য আসামিপক্ষের আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। তাই রায়ে আসামিরা ন্যায়বিচার পাবেন। মূলত নুসরাত মৃত্যুর আগে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল; সে চিঠি পুলিশ জব্দ করেছে। এ ছাড়া মেডিকেল রিপোর্টে চিকিৎসকরা এটিকে হত্যা বলেননি।’
চার্জশিটে অভিযুক্তরা হলেন-সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজউদ্দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার সাবেক সহসভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।
এর মধ্যে কিলিং মিশনে অংশ নেন শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ, উম্মে সুলতানা পপি ও কামরুন নাহার মনি। আর ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ ছাড়া দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় সোনাগাজীর (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন, এসআই ইউসুফ ও ইকবালকে। প্রত্যাহার করা হয় ফেনীর পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে।
সুত্রঃ আমাদের সময়
Leave a Reply