কোরবানির ঈদের আর দু দিন বাকি। গ্রামের টাকাওয়ালারা সুন্দর সুন্দর গরু কিনে এনেছেন। সেগুলো দেখতে ভিড় জমায় ইমন সহ পাড়ার ছেলেপুলেরা। দরিদ্র ইমনদের কল্পনায় গরু মাংসের ভূনার ছবি! বাটি ভরা পোলাওয়ের ছবি। অলৌকিক ভাবেই যেন সেই সম্মোহনী ঘ্রান ইমনের নাকে লাগে। বাবা মা সহ ৫জনের পরিবারের ছোট ইমন।। ক্লাস টু তে পড়ে। ঈদের বন্ধের আগে স্কুলে শেষ দিনেও ইমনদের আলোচনা ছিল এবার মাংস পোলাও খাবে। ঈদ আসছে কোরবানির ঈদ। সন্তানদের পোলাও মানুষের টান দেখে দরিদ্র বাবা বাড়ির পেপে নারিকেল ইত্যাদি বিক্রি করে কিছু মসলাপাতি কিনে এনেছেন। তারও লোভ লাগে তারও চোখে ভাসে তেলভাসা মাংসের বাটির ছবি। শেষ কবে মাংস খেয়েছিলেন উনারও মনে নাই। গ্রামে অনেকেরই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। ইমন বায়না ধরে কিন্তু তিনি চেপে যান। হয়ত দরিদ্র বলে বিয়ের দাওয়াত পান না, আবার কোন সময় দাওয়াত পেলেও উপহার কিনার সামর্থ্য নেই বলে যাওয়া হয় না! ইমনের মাংস খাওয়া হয় না! তারা বরাবরই কোরবানি ঈদের অপেক্ষা করে। শুধু দারিদ্রতা নয়। অন্য সমস্যায় ভোগে ইমনের বাবা। তার ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে ৬মাস আগে। আল্লাহর রহমত না শাস্তি জানেন না তিনি। আল্লাহ উনাকে ২জন অপরূপ মেয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে গ্রামে নানান ঝামেলা। ছেলেপুলের নানা উৎপাত করত! গ্রামের ও পাশের গ্রামের টাকাওয়ালা ও বখাটে ছেলেদের উৎপাত নিয়ে কত্ত বিচার শালিস! কোন সুবিচার পায় নি তারা। বরাবরই শালিসি সিদ্ধান্ত আসে মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দাও”
কিন্তু বিয়ের এত খরচ! এদিকটা কেউ শব্দ করে না। এরমধ্যে গ্রামের মাতব্বর গোছের ছেলের বাবারা বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু টাকা আর প্রভাব ছাড়া ছেলের কোন গুন না থাকায় বিয়ে দেন নি ইমনের বাবা।একপর্যায়ে আল্লাহ রহমত দান করলেন। এক প্রবাসী ছেলে যৌতুকবিহীন ও নিজ খরচে ছোট মেয়েকে ঘরে তোললো। এসব চোখে ভাসে ইমনের বাবার। অন্যদিকে ইমনের
অপেক্ষা শেষ হয়। ঈদের আগের রাত। ইমনের ঘুম হয় না। কখন সকাল হবে, কোরবানি হবে,মাংস আসবে! সকাল হল। সকাল বলতে ভোরেই গ্রামের ছেলেপুলে দলবেঁধে পাড়ার পুকুরে গোসল সেরে আসলো। কে কার আগে জামাকাপড় পরবে প্রতিযোগিতা চললো। ইমনের এ প্রতিযোগিতা নয় সে বাবাকে বলেই রেখেছে, জামা নয় মাংসের ঝুলের বাটি চাই। মাংস চাই।
ঈদের জামায়াত শেষে ইমাম ও মুয়াজ্জিন সাহেবরা একে একে বিভিন্ন বাড়ির গরু/খাসি কোরবানি করে দিলেন। উনাদের সাথে সাথে ইমনও ঘুরে। পাড়ার কোরবানি শেষ। বড়রা মাংস কাটাকাটি করে বিলি করা শুরু করেছেন। ইমন বাড়িতে আসে। তার মা ও বাবা বাড়িতেই আছেন। ইমন মা’কে তাগদা দেয়, মা মসলা করে রেখো। মাংস আসলেই রান্না করো! তেলভাসা ঘ্রানওয়ালা রান্না। ইমনের মা তারে ডাকেন, শুন বাবা, মাংস আসুক রান্না করে দিব
এখন মাংস ছাড়া পোলাও করেছি খেয়ে যা, ভোর থেকে কিছু খাস নি। ইমন বলে, না মা, আজ ঈদের দিন।মাংস দিয়ে পোলাও খাব। অপেক্ষা করতে করতে প্রায় দুপুর! মাংস তো আসে না! ভিতরে ভিতরে একটু গাবড়ে যাচ্ছেন ইমনের বাবা। ব্যাপার বুঝতে পারছেন না। পাশের ঘরে তো মাংস রান্না হয়েছে! তাদের ঘরে কি হলো। অন্য দিকে ইমনের হাহাকার যেন বেড়েই যাচ্ছে!
কি করবেন বুঝতে পারছেন না। ইমনের মা পাশের ঘর থেকে একটু মাংসের তরকারি এনে দিয়েছিলেন। ইমন খায় নি। সে তার ঘরের রান্না খাবে। কিন্তু,,,,,
দুপুরে কান্নাকাটি করে ইমন ঘুমালো। তার মা বাবা যেন অপরাধী হয়ে গেছেন! কেউ কারো মুখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছেন না। ইমনের বাবা ঘরের মোরগটা জবাই করলেন। ভাব দেখালেন এটা বিরাট কাজ। দারুন ব্যস্ত তিনি।
বারান্দায় থেকে ইমনের মা চুপচাপ চোখের পানি ফেলেন। ইমন ঘুম থেকে উঠে বিকেলে। তার মা বাবা প্লান করে মনে মনে তৈরি ছিলেন। তারা ইমনকে বেড়াতে নিয়ে যাবেন বলে বের হলেন ছোট মেয়ের বাড়ি।
ইমনও কিছু একটা বুঝে। সে কোরবানি বা মাংস নিয়ে প্রশ্ন করেনা। ছোটাপার বাড়ি যাচ্ছে এতেই সে খুশি।তিন গ্রাম পেরিয়ে তারা পৌছালো। মেয়ের বাড়ির লোকজন খুব ভাল। তারা অবস্থা জানে তাই মিষ্টির প্যাকেট বা কোরবানি নিয়ে কোন প্রশ্ন শুনতে হল না। অখানে ইমন তার মাংস পোলাও পেয়ে যায়। রাতে ফিরার সময় বেয়াইর বাড়ি থেকে বেশ কিছু মাংস পেয়ে গেলেন। রাতে বাড়ি ফিরে ইমনের মা রান্নায় বসলেন। তেলভাসা ঝুলঝুল রান্না করবেন। ইমনের বাবার একটা খটকা যাচ্ছে না। তিনি গ্রামের বেরুলেন। কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝলেন। ছোট মেয়েকে গ্রামের মাতুব্বরের বখাটে ছেলে কাছে বিয়ে না দেওয়া মাতুব্বর ক্ষেপে যান আর তিনি গোপনে সবাইকে বলে দেন এ ঈদে ইমনদের বয়কট করা হবে।
কৃষককের বাচ্চার কত বড় সাহস প্রায় জমিদার মাতুব্বরের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়! মাতুব্বর অপমানবোধ করায় অন্যান্যরা মাতুব্বরের সিন্ডিকেটে সায় দেয়। না হলে আবার বাজারের দোকানপাট আর বর্গাচাষে মাতুব্বর বিগড়ে যাবে! এক মাতুব্বর কে খুশি রাখতে গিয়ে নিরপরাধ এক পরিবার কে ঈদের হক থেকে বঞ্চিত করা হল!
ইমন কোরবানির মাংস খেয়েছে ঠিকই কিন্তু নিজ পাড়া থেকে সে হক বঞ্চিত হল কেন এটা বুঝার বয়স তার হয় নি। রাতে ইমনরা ঘুমালো। ইমনের বাবা চোরের মত নিজের ভিজা চোখ লুকালেন। ভোর বেলা মসজিদে মাইকের আওয়াজে ধড়ফড় করে উঠে পুরো গ্রাম! মাইকে জানানো হয় হার্টের সমস্যা মধ্যরাতে মারা যান মাতুব্বর!
গ্রামের সবাই মাতুব্বরের বাড়ি ভিড় করে। ইমনের বাবাও। লোকমুখে শুনলেন, হার্ট, উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরলের রুগী ছিলেন তিনি। এর মধ্যে প্রচুর মাংসভোজের কারনে উনার শরীর খারাপ হয়। মাঝরাতে গাড়িঘোড়া পেতে খুব দেরি হয়ে গেল! মাঝপথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন প্রায় জমিদার প্রভাবশালী মাতুব্বর। আসরের পরে মাতুব্বরের দাফন শেষ হলো।
রাতে ইমন তার মা’কে প্রশ্ন করে
মা, মাতুব্বর দাদা কি বেশি মাংস খাওয়ায় মারা গেল?
মা বলেন- মাংস খাওয়া একটা কারন ঠিকই কিন্তু খেয়াল রেখে শিক্ষা নাও উনার বড় বড় ফ্রীজ ভর্তি মাংস উনি আর খেতে পারবেন না!
একটু ঝিম মেরে যায় ইমন। তার ছোট্ট ভূবনে একটু আলোড়ন উঠে।
সৌজন্যেঃ সিলেটভিউ২৪ডটকম
Leave a Reply