যীশু অাচার্য্য:
ছোটবেলা থেকে সংক্রান্তি মানেই বছরের এই একটি সংক্রান্তি আমার কাছে ছিল বিশেষ একটা দিন। এই পৌষ সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকতো দীর্ঘ পূর্বপরিকল্পনা। প্রায় এক মাস আগে থেকেই শুরু হতো মাঠে মাঠে ন্যাড়া(কৃষকরা মাঠ থেকে ধান কেটে নেওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ/একপ্রকার খর) সংগ্রহের কাজ। সাধারণতঃ এ সময়টায় স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত প্রায়। আর তখন যেহেতু পড়ালেখা থাকতো না কাজেই প্রতিদিন একবেলা মাঠে মাঠে ন্যাড়া সংগ্রহ চলতো মহা সমারোহে। বাড়ির পাশের আঙিগনা(খলা)য় বিশাল বিশাল স্তুপ দিতাম সেগুলোর। আর পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন চলতো ভেড়া-ভেড়ি(ভেড়ার ঘর) তৈরির কাজ। এতে লাগতো বাঁশ আর খড়। প্রথমে একটি উঁচু বাঁশকে খড় দিয়ে মুরিয়ে মাটিতে পোতা হতো। আরকেটি ছোট বাঁশকে খড়ে পেছিয়ে প্রথম বাঁশের সাথে আড়াআড়ি বেঁধে হাতের আকার দেয়া হতো। পরে মাটিতে পোতা বাঁশটিকে কেন্দ্র করে চারদিকে বৃত্তাকারে, সংগ্রহকৃত ন্যাড়া/খড় দিয়ে বোঝাই করা হতো। মধ্যে দেয়া হতো বিশেষ ধরনে বাঁশ। পাতলা আর আখি বিশিষ্ট, যা আগুনের তাপে বিস্ফোরিত হতো বিকট শব্দে। প্রতিটি শব্দের সাথে সাথে হৈ…হৈ….. রব দিতাম সবাই। গ্রামে প্রায় ৪/৫ টি ভেড়া-ভেড়ি তৈরি হতো। কার ঘরে কতটি বিস্ফোরন হতো তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। রাতে পাহাড়া দিতাম যাতে কেউ এসে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে না যায়।বন্ধু অপুল,সুমন সহ কয়েকজন মিলে ভেড়ার ঘরে থাকতাম। নির্ঘুম রাতকে আনন্দময় করে তোলার জন্য আনুষাঙ্গিক আয়োজনও থাকতো। যেমন, মাংস রান্না করে খাওয়া, মাইক বাজিয়ে গান করার, ক্যাসেট প্লেয়ারে সারারাত গান চলতো। তখনতো আর এম্পি ফোর কিংবা এম্পি থ্রি ছিল না। আমরা ক্যাসেট প্লেয়ারে গান চালিয়ে তার সামনে মাইক্রোফন ধরে মাইকে বাজাতাম। এসব আনন্দযজ্ঞে সামিলে থাকতেন আমাদের চেয়ে কয়েক বছরের সিনিয়র ভাইরাও। তাদেরকে আমরা সামিল রাখতাম মূলত ফান্ডিংএর সুবিধার জন্য। তখনতো আমাদের পকেটে মাইক ভাড়া করার, মাংস কেনার এত টাকা থাকতো না। যাইহোক, পরদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন ভোরে উঠে (প্রায় ৪:০০টা) ঠান্ডা পানিতে স্না সেরে নতুন কাপড় পড়ে সবাই গিয়ে আগুন জ্বালাতাম ঐ ভেড়ার ঘরে। বাড়ির সব বয়েসর সকলে এসে আগুন পোহাতো এক সাথে। সে এক বিশাল অগ্নিযজ্ঞ। ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত চলত সে পর্ব। তারপর পিঠা খাওয়ার পালা। আগের দিন মা-কাকিরা বিকেল থেকে পিঠা তৈরিতে বসতেন। বাবা-কাকারা রাতে বড় বড় মাছ নিয়ে আসতেন বাজার থেকে। পরদিন গ্রামে গ্রামে সকালে সামাজিক কীর্তন শেষে সারাদিন চলত খাওয়া-দাওয়ার পালা। অার অাজ ডিজিটাল বৌ রা ঘরে বসে অর্ডার দেয় ইতালিয়ান পিৎজা। এখন পিঠা তো দুরের কথা কেউ কারো বাড়ি গেলে নাক টানে। অাজ এটা কেবল ফেসবুকে সীমাবদ্ধ। ২ টা পিক অাপলোড করলাম তো হয়ে গেল। অাগে চলতো ধুতি পাঞ্জাবী অার দেশী তাতের শাড়ী অার অাজ চলছে কিরনমালা জুতারমালা সহ ইত্যাদি অায়োজন। স্পন্সর বাই স্টার জলসা এন্ড জী বাংলা সিরিজ । দিনবদলের সাথে সেই অাবহমান ঐতিহ্য বিলুপ্তপ্রায়। অাজ যখন সেই স্মৃতিচারণ গুলো মনে হয় ভাবি কোথায় গেল সেই দিনগুলো। ফিরে পেতে চাই অাজো একবার হলেও। তবে সব মিলিয়ে দারুণ ছিল আমার ছোটবেলার পৌষ সংক্রান্তিগুলো।
অাসুন বিদেশী সংস্কৃতি বর্জন করে দেশী সংস্কৃতি কে লালন করি।
লেখকঃঃ- সাংবাদিক, কলামিস্ট।
Leave a Reply