নিউজ ডেস্ক।। ১৯৯৩ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এলোমেলো হয়ে যায় নব্বই দশকের তুমুল জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবন
২০১৫ সালে বলিউডে মুক্তি পায় ‘মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যান’ নামের একটি ছবি। বিহারের এক গরীব শ্রমিককে নিয়ে ছবির গল্প। আসলে গল্প নয়, একেবারে বাস্তব। যার মূলে ছিলেন দশরথ মাঝি। গেহলর গ্রামে যার বাস ছিলো। কিন্তু এই গ্রামের মানুষদের নিত্যদিনকার চাহিদা মেটাতে পায়ে হেঁটে প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় পাড়ি দিয়ে শহরে যেতে হত। সেই পাহাড় পাড়ি দিতে গিয়েই একদিন পড়ে যান দশরথের স্ত্রীর। রাস্তা না থাকায় চিকিৎসকের কাছে পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি স্ত্রীকে। মৃত্যু হয় তার।
সেই শোক সামলাতে না পেরে মনস্থির করলেন, ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরী করবেন। যেন তার স্ত্রীর মত আর কারো জীবন দিতে না হয়। শত প্রতিকূলতা মাড়িয়ে শুধু শাবল আর হাতুড়ি দিয়ে খোদাই করলেন ৩৬০ ফুট লম্বা, ২৫ ফুট গাঢ় ও ৩০ ফুট প্রশস্ত এক পথের! আর এতে তার সময় লেগে গেলো দীর্ঘ ২২ বছর! সত্য ঘটনা অবলম্বনে বলিউডের সেই ছবিতে দশরথ মাঝির চরিত্রে অভিনয় করেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী।
পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরী না করলেও বাংলাদেশে আছেন তেমনি একজন সংগ্রামী মানুষ। নাম তার ইলিয়াস কাঞ্চন। দশরথ মাঝির মতোই তারও আছে তেমন একটি ক্ষত, একটি শোক। যেই ক্ষত তিনি বয়ে চলেছেন বিগত ২৬ বছর ধরে। কী সেই ক্ষত?
১৯৯৩ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এলোমেলো হয়ে যায় নব্বই দশকের তুমুল জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবন। কারণ এ বছরের ২২ অক্টোবর তার একটি ছবির শুটিং দেখতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। শোকার্ত ইলিয়াস কাঞ্চন এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর সিনেমাও করবেন না! কিন্তু সব ভেবে রিলের নায়ক থেকে রিয়েল লাইফের প্রতিবাদী নায়ক হয়ে দাঁড়িয়ে যান রাস্তায়! গড়ে তোলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামের সংগঠন।
দশরথ মাঝি ২২ বছর কিছু না ভেবে পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করেছেন যেন তার স্ত্রীর মতো আর কারো মৃত্যু না হয়, তেমনি ইলিয়াস কাঞ্চন বিগত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। যেন তার স্ত্রীর মতো এমন মর্মান্তিক মৃত্যু আর কোনো পরিবারকে এলোমেলো না করে দেয়।
কিন্তু এই আন্দোলন করে বার বার বিভিন্ন মহলের হুমকির শিকার হয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে গত কয়েকদিন বাংলাদেশের বাস-ট্রাক শ্রমিকরা যে ‘কর্মবিরতি’ পালন করেছেন, সেখানে চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিযোগ উঠেছে। অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবি সম্বলিত ব্যানার টাঙিয়ে কিংবা কুশপুত্তলিকা তৈরি করে সেখানে জুতার মালা দেয়া হয়েছে।
এসব আচরণে কষ্ট পেলেও থেমে যাওয়ার পাত্র নন রাজপথের এই নিঃসঙ্গ যোদ্ধা। বলেছেন, নিজের ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে, নিজের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে সড়ক নিরাপদের যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, সেটা আমি চালিয়েই যাবো!
এদিকে ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণার নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নিন্দা জানানো হয়। তবে বহু সচেতন মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে যখন এমন বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় মেতেছে স্বার্থান্বেষি মহল, তখন কেন এসবের প্রতিবাদ করছেন না সিনেমা অঙ্গনে তার সহকর্মীরা? কোনো সংকটে শ্রমিক-পরিবহন মালিকরা একজোট হতে পারলে, ন্যায়ের পক্ষে কেন নেই ইলিয়াস কাঞ্চনের সিনেমা জগতের মানুষেরা? কেন তার পাশে দাঁড়াচ্ছেন না?
তবে এরমধ্যে অনেকেই ইলিয়াস কাঞ্চনের পাশে দাঁড়ানো ও তার নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও অভিনেতা জায়েদ খান জানিয়েছেন, ‘ইলিয়াস কাঞ্চন ভাই এর পাশে আমরা শিল্পীরা আছি।’ অভিনেতা ও নির্মাতা মাসুদ আখন্দ লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের যেটুকু অংশ সত্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকে সেই অংশের হিরো তিনি! তিনি আমাদের হিরো।’
ডেইলি স্টারের বিনোদন সাংবাদিক ও গীতিকার জাহিদ আকবর লিখেছেন: গত দু’ তিন ধরে ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে একটা পোস্টার চোখে পড়ছে। কিন্তু এটা নিয়ে কেউ কথা বলছেনা। তার সহকর্মীরাও চুপচাপ। যেন কিছুই হয়নি। উট পাখির মতো বালিতে মুখ লুকিয়ে আছেন। না দেখার ভান করে। কয়েকজন তারকাকে ফোন দিয়ে বলেছি চুপ কেন, কিছু একটা বলেন? ভালো উত্তর আসেনি। তাহলে কিসের দাম এতোদিনের সম্পর্কের? সিনেমার, রাজপথের আসল নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। প্রিয়জনকে হারিয়ে অন্যদের প্রিয়জন বাঁচানোর আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। স্যালুট আপনাকে নায়ক। ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে পরিবহন সন্ত্রাসীদের এমন আচরণে সবার এই নীরবতায় মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়।
সূত্র: চ্যালেন আই অনলাইন থেকে।
Leave a Reply