বছরের শুরুর দিনটি এভাবে শুরু হবে; তা ভাবতেই পারিনি। বিছানায় থাকতেই খবর পাই, আমাদের পণ্ডিত স্যার আর নেই। কিছু সময়ের জন্য যেনো আমার পৃথিবী স্তব্দ হয়ে গেলো! একটি অপরাধ বোধও কাজ করেছিল নিজের ভেতর। কারণ শেষ দিকে স্যার যখন খুব বেশী অসুস্থ ছিলেন, তখন অন্তত দু’বার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম স্যারকে দেখার। কিন্তু, যাবো যাবো করে আর যাওয়া হলো না। এ দুঃখবোধ অনেকদিন আমাকে তাড়িত করবে। ক্ষমা করবেন স্যার। পাণ্ডিত্য , মার্জিত আচরণ আর ব্যক্তিত্ব স্যারকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। স্যার হয়ে উঠেছিলেন সার্বজনীন। সবার শিক্ষক। একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। স্যারের চিকিৎসার সুখ্যাতি ছিল সর্বত্র। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা ভীড় জমাতো জয়পুর গ্রামে। পণ্ডিত স্যারের চিকিৎসা নিয়ে অনেক জনশ্রুতি আছে। বহু মুমূর্ষু রোগী বহু জায়গায় ব্যর্থ হয়ে পণ্ডিত স্যারের কাছে এসে আরোগ্য লাভ করতেন
সকলের প্রিয় পণ্ডিত স্যারের শুদ্ধ নাম শ্রী বীরেশ্বর ভট্টাচার্য্য। কিন্তু, ‘পণ্ডিত স্যার’ -এর কাছে পিতৃপ্রদত্ত নামটি ওই নামটি যে কবে হারিয়ে গেছে তা আমরা জানি না।
চিরকুমার এই জ্ঞানতাপসের বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পূর্ব জয়পুর গ্রামে। দীর্ঘদিন উপজেলা সদরে অবস্থিত দীননাথ ইনস্টিটিউশন সাতকাপন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সুনামের সাথে শিক্ষকতা করেছেন। স্যারের পাণ্ডিত্যের কাছে আমরা নতজানু ছিলাম। কি অসাধারণ স্যারের জানার পরিধি! ছোট্ট একটি উপজেলা শহরের স্কুল শিক্ষক হয়েও, চিন্তা-চেতনায় তিনি ছিলেন আধুনিক। একজন ‘গ্লোবাল টিচার’। ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত ছিমছাম গড়নের দীর্ঘকায় মানুষটি মুখে শোভা পেতো সাদা দাঁড়ি। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতো শুভ্র সুন্দর। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি স্যারের ব্যাগে বইয়ের পাশাপাশি থাকতো দুটি দৈনিক পত্রিকা। একটি ইংরেজী আর অন্যটি বাংলা। আমি ‘৯১-‘৯৫ সাল পর্যন্ত দীননাথ ইনস্টিটিউশন সাতকাপন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। পণ্ডিত স্যার আমাদের ইংরেজি আর ধর্ম শিক্ষা পড়াতেন। সৌভাগ্যক্রমে ওই প্রতিষ্ঠানে (ডিএনআই) আমার শিক্ষকতা করারও সুযোগ হয়েছিল। পণ্ডিত স্যার ২০০৭ স্যালে অবসর গ্রহণ করেন। আমি স্যারের পদে ২০০৮সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ২তারিখ শনিবার প্রতিষ্ঠানটিতে ধর্মীয় শিক্ষক (খণ্ডকালীন) হিসেবে যোগ দেই। আমি ২০১২ পর্যন্ত পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকতা করি। ওই সময়ে পণ্ডিত স্যার সম্পর্কে সহকর্মী স্যার-ম্যাডাদের কাছ থেকে শুধু ইতিবাচক কথাই শুনেছি।
সহকর্মীর কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া যথেষ্ট আত্মতুষ্টির বিষয়।
পণ্ডিত স্যারের পরিচিতি শুধু উপজেলায় সীমাবদ্ধ ছিল না। উপজেলা, জেলা ছাড়িয়ে সিলেট বিভাগের সর্বত্র তিনি পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে চিকিৎসক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন তিনি। স্যার ছিলেন অজাত শত্রু। সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ। সংসারে থেকেও সন্ন্যাসীর ন্যায় জীবন-যাপন করতেন সর্বদা।
নিরহংকারী ও সাদাসিধে এ মানুষটি সংসার করলেন না ঠিকই কিন্তু প্রতিনিয়ত সংসারের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছেন। আপন বড় ভাই ও ছোট ভাই অকালে চলে গেলে বিরাট সংসারের হাল ধরেন নিজেই। সংসারী না হলেও, সংসার উনাকে ছাড়লো না। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখলো।
স্বল্পভাষী পণ্ডিত স্যারের চলনে-বলনে ছিল পাণ্ডিত্যের ছাপ। প্রচুর পড়াশোনা জানা মানুষ ছিলেন তিনি। বিশ্ব সাহিত্যের অলিগলিতে হাটতেন সর্বদা। বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী এ মানুষটি জনসম্মুখে উপস্থিত হতে পছন্দ করতেন না। সব সময়ই থাকতেন আড়ালে। জোর করেও কোনো লেখা আদায় করতে পারতাম না আমরা। অথচ স্যারের মতো পড়ুয়া মানুষ জেলায় আরেকজন আছেন কিনা সন্দেহ আছে।
ভোর থেকে রোগীরা এসে বসে থাকতো। সারাদিন রোগী দেখতেন। রাতে পড়তে বসতেন। গভীর রাত অব্দি বইয়ের পাতায় ডুবে থাকতেন। কোনো কোনোদিন ভোর হয়ে যেতো।
স্যারের মৃত্যুর পর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই শোকাহত হয়েছেন। প্রিয় ছাত্ররা মর্মাহত হয়েছেন। এ লেখাটি লিখতে গিয়ে অন্তত ২০জন মানুষের সাথে কথা বলেছি; যারা প্রত্যেকেই স্যারের সাবেক ছাত্রছাত্রী। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, প্রত্যেকেই স্যারের সাথে ঘটে যাওয়া ভিন্ন ভিন্ন কিছু আচরণের কথা বললেন; যা আজও তাদেরকে প্রাণিত করে। হবিগঞ্জ শহরের এথেনটিক কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী নোমান খান বলেন, ‘তখন আমি ক্লাস সেভেনে পরি। শীত কাল। টেম্পুতে যাচ্ছিলাম। স্যারও যাচ্ছিলেন সাথে। হঠাৎ দেখি, স্যারের চাদরটি আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন। বারবার না করলেও ধমক দিয়ে পরতে দিলেন।’
ভেড়াখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা কনিকা গোপ বলেন, “একদিন স্যার আমাদের বাড়িতে আসলেন। পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোনো বই না দেখতে পেয়ে মা-বাবাকে লজ্জা দিয়ে বললেন, ‘কেমন শিক্ষিত পরিবার আপনাদের? কোনো পড়ার বই নেই ?’ এখন আমাদের পারিবারিক লাইব্রেরিতে প্রচুর বই। ওইদিন স্যার এভাবে লজ্জা না দিলে হয়ত লাইব্রেরি করা সম্ভব হতো না।” এভাবেই পণ্ডিত স্যার তাঁর জীবনাচরণের মাধ্যমে প্রচুর মানুষকে বদলে দিয়েছেন। দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন একজন আদর্শ শিক্ষক।।
কিন্তু, আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা স্যারের কাছ থেকে তেমন কিছুই আদায় করে নিতে পারিনি! নিজেদের প্রয়োজনেই পণ্ডিত স্যারদের মতো সর্বজ্ঞ মানুষের প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল আমাদের।কারণ, পণ্ডিত স্যারদের মতো মানুষেরা কালেভদ্রে পৃথিবীতে আসেন।
(লেখকঃ পংকজ কান্তি গোপ, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী)
Leave a Reply