স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশে এসেছেন হবিগঞ্জের সন্তান আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সারা জাগানো ফুটবল খেলোয়ার দেওয়ান হামজা চৌধুরী। মা এবং স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে তিনি দেশের মাটিতে পা রেখেছেন। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফাইটে তিনি সোমবার সকাল ১১টায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন। এবারের তার আসা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এবার আসছেন নিজ দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্ণামেন্টে খেলতে। তাই আনন্দের শেষ নেই এলাকাবাসীর মধ্যে। বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। হামজাকে বরণে পথে পথে তোরণ নির্মাণ করা হয়। বাড়ির প্রবেশ পথে গেইট নির্মাণ করা হয়। মঞ্চ প্রস্তুতও করা হয়েছে।
ফুটবলে হামজার হাতেখড়ি
ছোট বেলা থেকেই বেশ চঞ্চল ছিলেন দেওয়ান হামজা চৌধুরী। খেলাধুলার প্রতি তার ছিল বিশেষ ঝোক। বিভিন্ন খেলায় অংশ নিতেন। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতেন। জীবনে কোন খেলায় দ্বিতীয় হননি তিনি। মাত্র ৫ বছর বয়স থেকেই তার ফুটবল খেলা শুরু। খেলতেন পাড়ার ক্লাবে। ২০০৫ সালে ৭ বছর বয়সে মা বাবা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী লেস্টার ক্লাবে। তখন থেকেই তার ফুটবলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। স্কুল, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে তিনি খেলাধুলার উপর ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ক্লাবেই খেলতে থাকেন নিয়মিত। টানা ২০ বছর ধরে তিনি এখানে খেলছেন। কুড়িয়েছেন অনেক সুনাম। বিশ্বজুরে তার খ্যাতি ছড়িয়েছে।
এসব বিষয় বলতে গিয়ে তার বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ বলেন, একবার হামজা দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। কিন্তু তাকে দেয়া হয় দ্বিতীয় পুরস্কার। তাই সে পুরস্কার নেয়নি। কারণ সে জানে যে প্রথম হয়েছে। তার জীবনে কোন খেলায় সে দ্বিতীয় হয়নি। সব সময় প্রথম হয়েছে। তিনি বলেন, ৭ বছর বয়স থেকে সে লেস্টার ক্লাবের সদস্য হয়। তার খেলা দেখে সেই ছোট বেলা থেকেই বহু ক্লাব থেকে তাকে নেয়ার জন্য অফার এসেছে। কিন্তু আমরা রাজি হইনি। শুরু থেকেই লেস্টারে ছিল। এখনও সে লেস্টারেই আছে। এখানেই তার ফুটবলের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে হামজা
দেওয়ান হামজা চৌধুরী। জেলার বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার দেওয়ান বাড়ির সন্তান। জেলাজুড়ে এ বাড়ির খ্যাতি রয়েছে ব্যাপক। এখানে যেমন জন্মেছেন পীর মাশায়েখ, তেমনি জন্মেছেন অনেক গুণীজন। শিক্ষাবিদ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবই আছেন এ বাড়িতে। এবার যুক্ত হয়েছেন বিশ্বজুরে সারা জাগানো ফুটবল প্লেয়ারও। দেওয়ান হামজা চৌধুরীর জন্ম বেড়ে উঠা সবই ইংল্যান্ডে। পিতা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ। মাতা রাফিয়া চৌধুরী। মাত্র দেড় বা ২ বছর বয়সে ২০০০ সালে প্রথমবার দেশে আসেন। এরপর এসেছেন বেশ কয়েকবার। ২৭ বছর বয়সী এ যুবক ইতিমধ্যেই ফুটবলের বরপুত্র হিসেবে বিশ্বজুরে সারা ফেলেছেন। খেলেন লেস্টার কাবে। মাত্র ৭ বছর বয়স থেকে এ ভাবেই তার ফুটবলের আনুষ্ঠানিক হাতেখরি শুরু হয়। টানা ২০ বছর ধরে একই ক্লাবে খেলছেন। ইতিমধ্যে দেশেও এসেছেন বহুবার। কিন্তু এবারের আসা ভিন্ন। এবার তিনি এসেছেন নিজ দেশের হয়ে খেলতে। তাই এলাকাবাসীর মধ্যে আনন্দের ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। সাথে আসছেন বিদেশী স্ত্রী ও সন্তানরা। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে এটি তার প্রথম বাংলাদেশ সফর। তাই বিষয়টি আরও আনন্দিত করে তুলেছে মানুষজনকে। সোমবার সকাল ১১টায় তিনি মা ও স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখেন। বাড়ি পৌছতে বিকেল গড়িয়ে যায়। অপেক্ষার শেষ নেই উৎসুক জনতার মাঝে। তবুও কারও মাঝে কোন কান্তি নেই।
স্ত্রী সন্তানসহ বরণ
দেশে বহুবার এসেছেন দেওয়ান হামজা চৌধুরী। দেড় বা ২ বছর বয়স থেকেই তার দেশে আসা শুরু। কিন্তু এবারের আসা ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এবার আর একা নয়। সাথে আসছেন তার স্ত্রী, সন্তানরাও। তাদের জন্য বাংলাদেশে এটি প্রথম সফর। বধূ প্রথমবার আসছেন শ^শুরালয়ে। তাই বিদেশী বধূকে বরণে ব্যাপক আয়োজন করেছেন স্বজনরা। বাড়িকে সাজিয়েছেন বর্ণিল সাজে। পথে পথে করেছেন তোরণ। বাড়ির প্রবেশমুখ থেকেই করেছেন গেইট। পোস্টার, ফেস্টুনতো আছেই। লাইটিং করা হয়েছে বাড়িজুড়ে। আগত অতিথিদের ইফতারও করানো হয়। বাড়ির পাশে খালি জায়গায় ছোট একটি মঞ্চ তৈরী করা হয়। সেখানে ছোট্ট পরিসরে তিনি আগত অতিথিদের সাথে কুশল বিনিময় করেন।
হামজা চৌধুরীর চাচা দেওয়ান মাসুদ বলেন, ২০১৪ সালে সর্বশেষ দেশে এসেছিল হামজা। ২০২২ সালে সে বিয়ে করেছে। এরপর আসা তার দেশে আসা হয়নি। আমরা আনন্দে উদ্বেলিত। ভাতিজার সাথে এবার ভাতিজার বউ এবং নাতি, নাতনীদের আমরা দেখছি। মূলত তাদের বরণ করতেই বাড়ি সাজানো হয়েছে। আমাদের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছে। যা আসলে বলে বুঝানো যাবেনা। শুধু আমাদের বাড়ি নয়, পুরো জেলাজুড়ে মানুষের মাঝে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
হামজা চৌধুরীর বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ বলেন, অনেকেই সংবর্ধনার আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি বারণ করেছি। একেতো রমজান মাস। আবার সে অনেক জার্নি করে আসছে। ক্লান্ত থাকবে। মানুষজনও ক্লান্ত থাকবেন। তাই কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি। বলেছি এটিইতো শেষ আসা নয়। যেহেতু দেশের হয়ে খেলবে পরের বার এলে সংবর্ধনা দেয়া যাবে। এবার আমি নিজে বাড়িতে ছোট্ট আয়োজন করেছি। যেহেতু বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন আসছেন তাই সবার সম্মানে এ আয়োজন। ছোট্ট একটি মঞ্চ তৈরী করেছি। এখানে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। তারপর সবাইকে নিয়ে ইফতার। একটি রাত বাড়িতে থাকাই মূল উদ্দেশ্য। মঙ্গলবার ঢাকায় চলে যাবে।
হামজাকে নিয়ে স্বপ্ন দেশবাসীর
এবার দেওয়ান হামজা চৌধুরীর দেশে আসা শুধুই নিজ বাড়িতে বেড়াতে আসার জন্য নয়। এবার আসছেন তিনি নিজ দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে খেলতে। নিজ দেশকে নিয়ে বিশ^কাপ আসরে খেলতে স্বপ্ন দেখছেন, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন দেশবাসীকেও। এ জন্য প্রাণভরে দোয়া করছেন এলাকাবাসী। হামজার হাত ধরেই এবার না হয়, পরের বিশ^কাপ আসরে খেলবে প্রিয় বাংলাদেশ এমন প্রত্যাশা তার শৈশবের সাথীদের।
দেওয়ান হামজা চৌধুরীর শৈশবের খেলার সাথি আব্দুল আজিজ বলেন, ছোটবেলায় হামজা আমাদের সাথে পাড়ার মাঠে খেলেছেন। তখনই আমরা মনে করতাম হামজা একদিন অনেক দূর এগিয়ে যাবেন। এখন আমরা বিশ^াস করি হামজার হাত ধরেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি অচিরেই বিশ^কাপ খেলবে।
মাদ্রাসা ছাত্র আব্দুল মোমিন বলেন, দেওয়ান হামজা চৌধুরীর জন্য আমরা প্রাণভরে দোয়া করি। তিনি যেন আমাদের দেশকে নিয়ে একদিন বিশ^কাপ আসরে খেতে পারেন। আমরা বিশ^াস করি তিনি আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ্।
আয়াতুল কুরসি পড়ে খেলতে নামে হামজা
শৈশব থেকেই ধর্মের প্রতি অবিচল দেওয়ান হামজা চৌধুরী। নিজে নামাজ পড়েন। স্ত্রী অলিভিয়াও একজন ধর্মপ্রাণ নারী। হামজার বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ বলেন, শৈশবে আমরা ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়িয়েছি। সেখানে কোরআন শিক্ষা দিয়েছি। দ্বীনের শিক্ষা দিয়েছি। নামাজ পড়তে শিখিয়েছি। ঘর থেকে বের হলেই আয়াতুল কুরসি পড়তে হবে, খেলায় নামার আগে আয়াতুল কুরসি পড়তে হবে শিখিয়েছি। এগুলো সে নিয়মিতই পালন করে। একবারের জন্যও ভুলেনা। তার স্ত্রী অলিভিয়া একজন বৃটিশ মুসলিম। কিন্তু সে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। নামাজ, রোজা ইসলামী রিতিনীতি সবই সে নিয়মিত পালন করে।
স্ত্রীর ইচ্ছায় এতিমখানা প্রতিষ্ঠা
স্নানঘাট গ্রামে নিজ বাড়িতে একটি এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন কৃতি ফুটবলার দেওয়ান হামজা চৌধুরী। স্ত্রী অলিভিয়ার ইচ্ছায়ই তিনি ২০২২ সালে এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানে বর্তমানে ৩০ জন ছাত্র কোরআনের হাফেজ হওয়ার জন্য পড়ছেন। শিক্ষক আছেন একজন। এতিমখানাটির পূর্ণ খরচ বহন করেন তিনি নিজের আয় থেকে। মাদ্রাসার নামকরণ করেছেন বড় ছেলের নামে “দেওয়ান ঈসা হুসাইন চৌধুরী হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা”। মাদ্রাসা সংলগ্ন রয়েছে বিশাল মাঠ। শিশুদের বিকশিত হওয়ার রয়েছে বিস্তর সুযোগ।
মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, দেওয়ান হামজা চৌধুরীর বড় ছেলের নামে তিনি নিজে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এতিমদের দ্বীনি শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি এগুলো দেখাশোনা করেন। খরচ সবই তিনি নিজে বহন করেন। আমরা তার জন্য প্রাণভরে দোয়া করি তিনি যেন আরও বড় কিছু করতে পারেন। বাংলাদেশকে যেন তিনি বিশ^কাপ ফুটবলে নিয়ে গর্বিত করতে পারেন।
হামজা চৌধুরীর বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ বলেন, ২০২২ সালে ছেলেকে আমরা বিয়ে করাই। এরপর বৌমা বাংলাদেশে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা পোষন করে। তখন আমি বাড়ির কিছু অংশ এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা করার জন্য দিই। এখানেই তারা এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠা করে।
হামজার পছন্দের খাবার
বাঙালী খাবার হামজা চৌধুরীর বেশ পছন্দের। তিনি বাংলা খাবারের তালিকার মধ্যে মোরগ পোলাও বেশ পছন্দ করেন। এ তালিকায় রয়েছে ঘরোয়া পিঠা, পুলি। এর মধ্যে সন্দেশ (চালের গুড়ি বা ময়দা দিয়ে তৈরী এক ধরণের পিঠা), নারিকেলের পিঠা, সাজের পিঠা (ডিম ও ময়দা দিয়ে তৈরী এক ধরণের পিঠা)। তবে তার সবচেয়ে পছন্দের একটি খাবার বাংলাদেশে তৈরী বার্মিজ আচার। শৈশব থেকেই তিনি দেশে এলে এটি বেশি খেতেন।
এমনটি জানিয়ে তার চাচা দেওয়ান মাসুদ বলেন, হামজা ছোট বেলা থেকেই দেশে এলে বার্মিজ আচার খেতো। এটি তার খুব পছন্দের। তবে ঘরোয়া পিঠার প্রতি তার অন্যরকম ঝোক রয়েছে। তাই দু’দিন ধরে বাড়িতে মহিলারা তার জন্য পিঠা তৈরীতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
হামজা চৌধুরীর বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ বলেন, হামজা সবচেয়ে পছন্দের খাবার মোরগ পোলাও। এটি তার স্ত্রীও বেশ পছন্দ করে।
হামজার নিরাপত্তা
দেওয়ান হামজা চৌধুরীর নিরাপত্তায় কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। খোলামেলা হামজার বাড়িটি পরিবারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে। বাড়ির চারপাশে নতুন টিনের বেড়া নির্মাণ করো হয়েছে। প্রধান ফটকগুলোতে রাখা হয়েছে নিরাপত্তা কর্মী। তারা প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত হয়েই বাড়ির ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছেন।
হামজার নানা কাজী আব্দুল মতিন বলেন, হামজার এবারের আসা কিন্তু ভিন্ন। এবার সে আর নিজের বাড়িতে আসছেনা। এবার আসছে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার জন্য। তাই তারা যেন সাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমরা পুরো বাড়িটি তাদের নিরাপত্তায় বেস্টনি দিয়েছি।
Leave a Reply