শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৮ পূর্বাহ্ন

৭ মাস পর চুনারুঘাটে অজ্ঞাত যুবতী হত্যার ক্লো উদঘাটন: স্ত্রীর চাপে ধর্ষনের পর হত্যা দায় স্বীকার গ্রেফতার ২

নুর উদ্দিন সুমন, বার্তা সম্পাদক
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০
  • ৪৭৪ বার পঠিত

নুর উদ্দিন সুমন: জেলার চুনারুঘাট উপজেলার রাণীগাঁও ও চাটপাড়ার মধ্যবর্তী যোগীর আসন ঠিলার নিছ থেকে উদ্ধার অজ্ঞাত যুবতী পরিচয় ও হত্যার ক্লো উদঘাটন করেছে পুলিশ । উদ্ধার যুবতী রোখসানা আক্তার মিষ্টি নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার কামালপুর গ্রামের মৃত খোরশেদ আলী মজুমদারের মেয়ে। গতকাল রাতে হবিগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বিপিএম,পিপিএম এর সার্বিক নির্দেশনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ নাজমুল হক এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর (তদন্ত) চম্পক দাম, এসআই মুসলিম উদ্দিনসহ একদল পুলিশ শায়েস্তাগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত আফছার ওরফে কাউছার ও তার স্ত্রী রিপা আক্তারকে গ্রেফতার করেন। এর পর নিবিড় তদন্তে নামেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও এস আই মুসলিম উদ্দিন। অবশেষে লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন করা হয়। ৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান উদ্দিন প্রধানের আদালতে কা:বি: ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে। এঘটনায় বিকাল ৫ ঘটিকায় হবিগঞ্জের পুলিশ সুুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বিপিএম পিপিএম তার কার্যলয়ের সম্মেলণ কক্ষে এক প্রেস ব্রিফিং এ আসামীদের বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা জানান, স্ত্রীর ক্রমাগত চাপে ঘাতকের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে স্ত্রীর সহায়তায় পরকিয়ার প্রেমিকাকে ধর্ষণের পর গলায় গামছা পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে গলায় কেচি ডুকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পরকিয়ার প্রেমিক আফছার ওরফে কাউছার ও তার স্ত্রী রিপা আক্তার।

পরে তাকে রানিগাও ও চাটপাড়ার মধ্যবর্তী এলাকার যোগীর আসন ঠিলার নিছে দক্ষিণ পাশে ফেলে পালিয়ে যায়। উল্লেখ্য গত ৭ ফেব্রয়ারী সকালে চুনারুঘাট থানাধীন ০৯নং রানীগাঁও ইউ/পিস্থ রানীগাঁও ও চাটপাড়া গ্রামের মাঝামাঝি হাওড়ে যোগীর আসন টিলায় একজন অজ্ঞাতনামা তরুণীর রক্তাক্ত মৃতদেহ পেলে চুনারুঘাট থানায় উক্ত মামলা রুজু করা হয়। যার মামলা নং ৭ পরবর্তীতে আসামীদ্বয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অজ্ঞাতনামা তরুণীর নাম পরিচয় শনাক্ত করা হয়। ভিকটিম মিষ্টি মৌলভীবাজার শহরে একটি বেসরকারি কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতো। গত ৬ ফেব্রয়ারী দিবাগত রাতে চুনারুঘাট থানাধীন ৯নং রানীগাঁও ইউপিস্থিত যুগীর আসন নামক টিলায় অনুমান ২২ বছর বয়স অজ্ঞাত নামা তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। তরুণীর তুথনীর নিচে ধারালো জখম থাকায় পুলিশ নিশ্চিত হয় এটি হত্যাকাণ্ড। অজ্ঞাত নামা তরুণীর নাম-ঠিকানা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত না হওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা রুজু করেন। হত্যাকাণ্ডের পর চুনারুঘাট সদর হাসপাতালের জনৈক নার্সের পালিত কন্যা সুমি আক্তারের নিখোঁজের সূত্র ধরে পুলিশ তদন্ত শুরু করে। সুমি আক্তারের মায়ের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য বিজ্ঞ আদালতের অনুমতি পাওয়ার পর সুমির ভাই তার বোনকে ফিরে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। পুলিশ অন্য সূত্র খুঁজতে থাকে। অনুমান ২০/২৫ দিন পূর্বে অত্র মামলার ঘটনাস্থল পার্শবর্তী এলাকা করাঙ্গী নদীর তীরে একজন অজ্ঞাতনামা লোক জনৈক ফারুক নামের এক লোককে ঢাকা থেকে এনে হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরিকাঘাত করা হয়। উক্ত ঘটনার তদন্তকালে পুলিশ জানতে পারে পাচারগাঁও গ্রামের এক লোক তার পরিচয় গোপন করে কাওছার নামে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে। পুলিশ বর্ণিত কাওছারের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারে। পুলিশ আরো তথ্য পায় কাওছারের প্রকৃত নাম আফছার এবং সে অত্র মামলার ঘটনার দিন রাতে তার স্ত্রী রিপা বেগমসহ একটি অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে পাচারগাঁও তার মায়ের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিল। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঐ রাতেই তারা চলে যায়। কাওছারের মা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জানায় ঘটনার দিন রাতে তার ছেলে আফছার তার স্ত্রী ও জিন্স প্যান্ট পরিহিত একটি মেয়েসহ বেড়াতে এসেছিল। পুলিশ উক্ত হত্যাকাণ্ডে আফসারের জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করতে তৎপর হয়। এক পর্যায়ে মহিলা পুলিশ আফসারের সাথে প্রেমের অভিনয় শুরু করে। প্রেমিক আফসার তার প্রেমিকা দেখতে আসলে সে পুলিশের জালে ধরা পড়ে। পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। এবং ভিকটিমের নাম মিষ্টি বলে জানালেও তার প্রকৃত পরিচয় জানে না বলে জানায়। তবে মেয়েটি মৌলভীবাজার শহরে ডিটারজেন্ট কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতো। এই সূত্র ধরে মেয়েটির সঠিক নাম পরিচয় জানা যায়। মেয়েটির নাম রোকসানা আক্তার (২২), পিতা- মৃত খোরশেদ আলম মজুমদার, তার পিতা সড়ক ও জনপদ পরিদর্শন মৌলভী বাজারে কাজ করতেন। বর্তমানে তারা সড়ক ও জনপদ পরিদর্শন বাংলো, রূপশপুর, শ্রীমঙ্গলে থাকেন। মেয়েটি তার মায়ের সাথে রাগ করে মৌলভীবাজার শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতো। হত্যাকণ্ডের প্রায় এক মাস আগে একদিন ঘটনাচক্রে আসামী রিপার সাথে জনৈক শুকলা এবং ভিকটিম মিষ্টির পরিচয় ঘটে। ঐ সময়ে ভিকটিম মিষ্টি ও শুকলা থাকার জন্য মৌলভীবাজার শহরে ভাড়া বাসা খুঁজতেছিল। এই সংবাদ জানতে পেরে ভিকটিম মিষ্টি ও শুকলাকে রিপা সাবলেট হিসেবে থাকার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি হয়ে শুকলা ও মিষ্টি মৌলভীবাজর শহরে জনৈক চাঁদ মিয়ার দূর্গামহল্লাস্থ রিপার ভাড়া বাসায় ওঠে বসবাস করতে থাকে। ঐ বাসায় অপর আসামী রিপার স্বামী মোঃ আফসার মিয়া উরফে কাওছারও থাকতো। কিছুদিন পর শুকলা সেখান থেকে অন্যত্র চলে যায়। এক বাসায় থাকার সুবাদে ভিকটিম মিষ্টির সাথে রিপার স্বামী মোঃ আফছার মিয়া উরফে কাওছার এর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে অনৈতিক দৈহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই নিয়ে স্বামী মোঃ আফছার মিয়া উরপে কাওছারের সাথে রিপার সম্পকের্র চরম অবনতি ঘটে। প্রায়ই এ নিয়ে স্বামী মোঃ আফছার মিয়া রিপাকে মারধর করতো। ঘটনার আগের দিনও স্বামী মোঃ আফছার মিয়া কাউছার তার স্ত্রী রিপাকে গালিগালাজ ও মারধর করিলে রিপা মনের দুঃখে হবিগঞ্জ সদর থানাধীন ধুলিয়াখালস্থ সৎ বাবার বাড়িতে চলে আসে। পরের দিন ৬ ফেব্রয়ারী সন্ধ্যায় মোঃ আফসার মিয়া উরফে কাওছার তার স্ত্রী রিপাকে ফোন করে দুঃখ প্রকাশ ও অভিমান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে। রিপা আক্তার মিষ্টিকে মেরে ফেললে স্বামীর কাছে আসবে বলে স্বামীকে শর্ত দেয়। আসামীদ্বয় মোবাইল ফোনেই মিষ্টিকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। মিষ্টিকে মৌলভীবাজার থেকে সাথে নিয়ে শায়েস্তাগঞ্জ নতুনব্রীজে আসে। এরপর মিষ্টি ও রিপার স্বামী রিপাকে শায়েস্তাগঞ্জ নতুনব্রীজ এলাকায় আসার জন্য অনুরোধ করলে রিপা রাত অনুমান সাড়ে ৮টায় নতুনব্রীজ এলাকায় আসে। সেখানে রিপা তার স্বামীকে মোবাইল ফোনে বলে যদি তুমি মিষ্টিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারো তাহলে আমি তোমার ঘর-সংসার করবো। নতুবা কোনদিন আমি তোমার সংসারে ফিরে যাবো না। এমতাবস্থায় রিপার ক্রমাগত চাপে রিপার স্বামী মিষ্টিকে মারতে সম্মত হয় এবং মিষ্টির আড়ালে তারা দুজনে হত্যার পরিকল্পনা তৈরি করে। তারই অংশ হিসেবে রিপার স্বামী আফসার নতুনব্রীজের ফুটপাত সংলগ্ন জনৈক পান বিক্রেতার নিকট থেকে কৌশলে একটি ধারালো কেঁচি (সিজার) সংগ্রহ করে।
কেঁচিটি কৌশলে প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে গাড়িতে করে রিপার স্বামী রিপা ও মিষ্টিসহ তার নিজ বাড়ীর দিকে রওয়ানা করে। রাত অনুমান ১০ ঘটিকার দিকে তারা মোঃ আফসার মিয়া উরফে কাওছার এর বাড়ীতে পৌঁছায়। চুনারুঘাট থানাধীন পাচারগাঁও সাকিনস্থ তার পিতার বসত বাড়ীতে এসে খাওয়া দাওয়া করে। খাওয়া দাওয়া শেষে পুনরায় মৌলভীবাজার শহরে তাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলে আসামীদ্বয় ভিকটিম মিষ্টিকে কৌশলে চুনারুঘাট থানাধীন ০৯ নং রানীগাঁও ইউ/পিস্থ রানীগাঁও ও চাটপাড়া গ্রামের মাঝামাঝি হাওড়ে যোগীর আসন টিলায় নিয়ে আসে। আসার পথে স্বামী এবং স্ত্রী ভিকটিম মিষ্টিকে মেরে ফেলার কথা ইশারা ইঙ্গিতে একে অপরকে আদান প্রদান করে। টিলায় আসার পর প্রথমে স্ত্রী রিপা আক্তারের সহায়তায় বিবাদী আফসার ভিকটিম মিষ্টিকে টিলার পাদদেশে ফেলে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষ হওয়া মাত্রই আসামী রিপার সহায়তায় আফসার ভিকটিম মিষ্টির পরিধেয় কালো ওড়না দিয়া মিষ্টির গলায় ফাঁস লেগে মিষ্টিকে হত্যা করে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য আফসার তার সঙ্গে আনা ধারালো কেঁচি দ্বারা ভিকটিম মিষ্টির থুতনীর নিচে গলায় সজোরে ঘাঁই মারে। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করে আসামী আফছার মিষ্টির পরিচয় গোপন রাখার জন্য তার পড়নের জিন্স প্যান্ট খুলিয়া ফেলে এবং মিষ্টির সাথে থাকা মোবাইল ফোন ও ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে যায় এবং মিষ্টির জুতাসহ অন্যান্য পরিধেয় বস্ত্র ঘটনাস্থলে ফেলে রেখে চলে যায়। এছাড়াও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রক্তমাখা কেঁচি (সিজার) ঘটনাস্থলে ফেলে যায়। হত্যাকাণ্ডের পরে ঘটনাস্থলের পাঁচশত গজ দূরে একটি ছোট খালের পানিতে আসামী আফছার তার দুই হাতে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে ফেলে। এরপর তারা দুজনে ঐ রাতেই মৌলভীবাজার শহরে ফিরে যায়। ভিকটিমের মোবাইল ফোনটি আসামী আফসার মৌলভীবাজার শহরে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়। আজ বিজ্ঞ আদালতে দোষ স্বীকার করে আসামীদ্বয় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..

Leave a Reply

Your email address will not be published.

© All rights reserved © 2019 Prothomsheba
Theme Developed BY ThemesBazar.Com