নিজস্ব প্রতিনিধিঃ তিউনিসিয়ায় ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে দুই যুবক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লোকড়া গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। দুই যুবকের স্বজনদের কান্নাকাটিতে শুকিয়ে গেছে চোখের জল। তাদের স্বজন হারানোর বেদনা ছুয়ে যাচ্ছে পুড়ো গ্রামবাসীকে। সোমবার শত শত লোক ভীড় জমান মোক্তাদির হোসেন ও আব্দুল কাইয়ুমের বাড়ীতে। হবিগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও চেম্বার প্রেসিডেন্ট মোতাচ্ছিরুল ইসলাম এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেন রুবেল সোমবার দুপুরে দুই বাড়ীতে যান এবং স্বজনদের সান্তনা দেন। সরজমিনে লোকড়া গ্রামে গেলে দেখা যায় লোকজন বোরো ধান তুলতে ব্যস্ত। তবে মোক্তাদির হোসেন ও আব্দুল কাইয়ুমের বাড়ীতে ভীড় লেগেই আছে। মোক্তাদিরের বাবা আব্দুল জলিল একজন সাধারন কৃষক। তিনি জানান, তার ছেলে কলেজে লেখাপড়া করে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে চাকুরী করতেন। ভালই চলত তার পরিবার। কিন্তু বানিয়াচং উপজেলার হিয়ালা গ্রামের দালাল মোফাচ্ছির মিয়া ও ঢাকার দালাল রহমত মিয়া আমার ছেলেকে লোভ দেখায় এখানে চাকুরী কইরা কয় টাকা পাইবায়। এর ছেয়ে ইতালী চলে গেলে বেশী টাকা রোজগার করতে পারবায়। তাঁর কথা শুনে আমার ছেলে বিদেশে যেতে পাগল হয়ে যায়। আমি বলেছিলাম বিদেশে গিয়া লাভ নাই বাবা। কিন্তু আমার ছেলে কথা না শোনায় আমি জমি জমা বিক্রি করে তাকে বিদেশে পাঠাই।
কান্না জড়িত কণ্ঠে আব্দুল জলিল বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার একদিন আগে আমাকে ফোন দিয়ে মোক্তাদির বলে ‘আব্বা আমি বাইরোডে ইতালি পাড়ি দেবো কাল, জানি না কী হবে। তবে মনে বড় আশা। দোয়া করো, আম্মারেও বলবা দোয়া করতে’। আমি তারে বলছিলাম তোমার ইতালি যাওয়া লাগবে না, বাড়ি চলে আসো। দরকার হলে আমরা না খেয়ে থাকবো।
মোক্তাদিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেলো-নামাজের বিছানায় বসে কান্নাকাটি করছেন মা ফাতেমা বেগম। পাশে বসা তার বাবা। পরিবারের সদস্যরা একেক জন একেক জায়গায় স্তব্দ হয়ে বসে রয়েছেন। ফাতেমা বেগম এ প্রতিনিধিকে জানান, তার ছেলে মোক্তাদির লেখাপড়া-পাশাপাশি বেসরকারি চাকুরী করতেন। এর মধ্যে দালাল মোফাচ্ছির এর সাথে তার পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে মোফাচ্ছির তাকে ঢাকার দালাল রহমতের মাধ্যমে ইতালীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অফার দেয়। এতে মুক্তাদির রোজি হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তার মা, বাবাকে রাজি করায়। ফাতেমা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন-দালাল মোফাচ্ছির সহজ ভাবে তাদের ইতালী পৌছে দেয়ার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু আমার ছেলেকে আজ হারাতে হচ্ছে। আমাদের সন্তানকে ফেরত পেতে চাই এবং দালাল মোফাচ্ছির ও রহমতের বিচার চাই। নিখোঁজ অপর যুবক আব্দুল কাইয়ুম এর বাবা হাজী আলাউদ্দিনের পরিবারের লোকজনও হতবিহবল। হাজী আলাউদ্দিন বলেন ‘দালাল মোফাচ্ছির ও রহমত মিয়ার জন্য তার সর্বনাশ হয়েছে। এখন তার ছেলেও গেল সম্পদও গেল। দালাল মোফাচ্ছির ও রহমতের বিচার চান তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমার ৮ ছেলে। এর মাঝে নিখোঁজ ছেলেটি সবার ছোট। অনার্স ভর্তি হওয়ার পর থেকেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সে। এক পর্যায়ে বিদেশে যাওয়ার কথা বলে। তার স্বপ্ন পূরণে আমার ৮ ছেলে থাকা সত্ত্বেও ৯ লাখ টাকা দিতে সম্মত হই। এসব বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম বলেন, এই ঘটনা শুনে আমরা লোকড়া গ্রামে গিয়ে নিখোঁজ যুবকদের পরিবারের সদস্যদেরকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেছি। এভাবে যারা অবৈধ পথে জীবনের ঝুকি নিয়ে মানব পাচারের কাজ করে তাদের বিচার হওয়া প্রয়োজন।
লোকড়া ইউপি চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ আব্বাস জানান প্রায় ৫ মাস পূর্বে সমবয়সী ৪ জন মিলে ঠিক করেন স্বপ্নের দেশ ফ্রান্সে যান। পরবর্তীতে বানিয়াচং উপজেলার হিয়ালা গ্রামের এক দালের মাধ্যমে তারা বাড়ি থেকে বের হন। ইতালী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য তাদের মধ্যে মাথাপিছু ৯ লাখ টাকা কিস্তিতে দেয়ার চুক্তি হয়। প্রথম কিস্তির টাকা পরিশোধের পর প্রথমেই তাদেরকে নেয়া হয় ভারতে। সেখানে ৫ দিন রাখার পর শ্রীলঙ্কায় নিয়ে রাখা হয় প্রায় সাড়ে ৪ মাস। শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত যেতে মাথাপিছু আদায় করা হয় ৭ লাখ টাকা। সর্বশেষ গত ৯ মে তাদেরকে ইতালী নেওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকায় ওঠানো হয়। ইতালী গিয়ে পৌঁছলে বাকী ২ লাখ টাকা পরিশোধের কথা ছিল।
তিনি আরও বলেন, তার এলাকার দরিদ্র কৃষক পরিবারের এই সন্তানরা দালালোর প্রলোভনে পড়ে জমি-জমা বিক্রি করে বিদেশে যাওয়ার জন্য টাকা যোগাড় করে।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ বলেন, দুঃখজনক এই ঘটনার খবর নিতে পুলিশকে বলা হয়েছে। দালালরা যাতে এ ধরনের নিরিহ লোকজনকে অবৈধপথে বিদেশ না পাঠাতে পারে তার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।
এদিকে আলোচিত দালাল রহমত মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সে ইতোমধ্যে আত্মগোপনে চলে গেছে বলে তার এলাকার লোকজন জানান।
Leave a Reply