স্টেমসেল থেরাপি বাংলাদেশের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের নতুন আশার আলো এ চিকিৎসাব্যবস্থা। একটা সময় সিনেমা অথবা টেলিভিশনের নাটকে নায়ক অথবা নায়িকাকে কোনো কারণে মেরে ফেলতে চাইলে কাহিনীতে বেদনাবিধুর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ব্লাড ক্যান্সারের প্রসঙ্গ আনা হতো। চরিত্রে দেখানো হতো যে নাটকের প্রধান চরিত্রের ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। এর কোনো চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। যেতে হবে সিঙ্গাপুর অথবা ভারতের মাদ্রাজে। এতে ৫০ লাখ টাকা খরচ হবে। এত টাকা পরিবারের কারো নেই।
অতএব নাটক বা সিনেমার ওই চরিত্রের ধীরে ধীরে মৃত্যুই শেষ পরিমাণ হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এসব নাটক বা সিনেমার কাহিনীর এখন আর কোনো স্থান নেই। ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা চলে এসেছে বাংলাদেশেও। সরকারিভাবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং স্বায়ত্তশাসিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক পিজি) স্থাপন করা হয়েছে স্টেমসেল থেরাপি সেন্টার। রোগীর দেহ থেকে স্টেমসেল নিয়ে সেখানে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আবার রোগীর দেহে সেই প্রক্রিয়াজাত স্টেমসেল প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় এ পদ্ধতিতে। ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বোনম্যারোকে প্রতিস্থাপন করে দেন চিকিৎসকেরা। হাড়ের মধ্যে থাকা কোমল অথচ স্পঞ্জি কোষকে তুলে ফেলে সেখানে সুস্থ ও ভালো স্টেমসেল প্রতিস্থাপন করে দেয়া হয়। থ্যালাসেমিয়াসহ ব্লাড ক্যান্সারের সব রোগীকেই সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ২০টির বেশি স্টেমসেল থেরাপির মাধ্যমে ব্লাড ক্যান্সার, থ্যালাসেমিয়ার আক্রান্ত রোগীর ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে।
স্টেমসেল থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসার সফলতা ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০১৪ সালের ১০ মার্চ এ চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪টি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি মাল্টিপল মাইলোমা, দু’টি ডিফিউজ লার্জ বিটা সেল লিম্ফোমিয়া, একটি একিউট মাইলোজেনাস লিউকেমিয়া, একটি হজকিনস লিম্পোমিয়া ও একটি পেরিফেরাল টি-সেল লিম্ফোমিয়ার রোগী। এর আগে ২০১৩ সালের ২০ অক্টোবর উচ্চ প্রযুক্তির মেশিন বসানো হয় ঢাকা মেডিক্যালের নতুন ভবনের ৯ তলায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইউনিট উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের উচ্ছ্বসিত বক্তব্য ছিল, ‘বাংলাদেশের চিকিৎসায় নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ব্লাড ক্যান্সার রোগীদের জন্য এটা একটি নতুন আশা।’
বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে ১১ শতাংশ ব্লাড ক্যান্সারে (রক্ত রোগ) আক্রান্ত। ব্লাড ক্যান্সার হলে আপনা থেকে রক্তের সেলগুলো (কোষ) ভেঙে যায়। ফলে শরীরে রক্তের ঘাটতি দেখা দিতে থাকে। একসময় আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যায়।
ভারতে গিয়ে এ চিকিৎসা নেয়া হলে হাসপাতালভেদে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ হয়ে থাকে। আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরে গেলে লাগে কোটি টাকার বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায় চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে।
সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের (এমজিএইচ) সহযোগিতায় বাংলাদেশে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। এই ইউনিটের চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানদেরও তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই সেন্টারটির জন্য যথেষ্ট বেড রয়েছে, কিন্তু জনশক্তি কম থাকার কারণে সেন্টারটির সামর্থ্য অনুসারে রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না। সরকার ঢাকা মেডিক্যালের এ সেন্টারটিতে ২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে, কিন্তু সেন্টারটি যথাযথভাবে কাজ করতে হলে আরো কিছু আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য তার সামর্থ্যরে পুরোটাই কাজে লাগানো যাচ্ছে না নানা জটিলতায়। এখানে রয়েছে প্রয়োজনীয় জনশক্তির ঘাটতি। অবশ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কোনো সমস্যা নেই। তারা ২০১৮ সালে শুরু করেছে। এই দু’টি সেন্টার পুরোপুরি তাদের সমার্থ্য অনুযায়ী কাজ করলে ব্লাড ক্যান্সার দূর করতে বিরাট ভূমিকা পালন করবে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ২০১৪ সালের ১০ মার্চ প্রথম স্টেমসেল থেলাপি চিকিৎসা শুরু করে ৫২ বছর বয়সী ‘মাল্টিপল মাইলোমা’ রোগের একজনকে দিয়ে। তিনি ২০০৯ থেকে মাল্টিপল মাইলোমার রোগী ছিলেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রথম রোগীর চিকিৎসা করেছে বিনামূল্যে। এর আগের বছরের অক্টোবরে তার দেহ থেকে স্টেমসেল সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। হাইডোজের কেমোথেরাপি প্রয়োগ করে প্রথমে রক্তের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে নষ্ট করে ফেলা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম এ খানের তত্ত্বাবধানে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে স্টেমসেল ট্রান্সপ্ল্যান্টের পঞ্চম রোগী ছিলেন উত্তরবঙ্গের ইয়াসমিন। পঞ্চম রোগী হলেও তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা রোগী। তিনি প্লাজমা সেল লিউকেমিয়া নামক ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন।
২০১৩ সালের নভেম্বরে ইয়াসমিনের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। রোগটি চিকিৎসায় যে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার প্রয়োজন হয় এর বাইরে রোগীকে ওষুধ কিনে দিতে হয়। এসব ওষুধের কোনোটাই বাংলাদেশে উৎপাদন হয় না। বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় সব ওষুধ। ফলে এগুলো অনেক বেশি দামি। ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা এখানে হয় না বলে এসব ওষুধেরও প্রয়োজন হয় না। ফলে আমাদের ওষুধ কোম্পানিগুলো এ ধরনের ওষুধ উৎপাদন করে না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্টেমসেল থেরাপি সেন্টারে রোগীর নিজের বোনম্যারোকেই ব্যবহার করা হয়। এটাকে বলা হয় অটোলোগাস। রোগীর নিজের দেহ থেকে সংগ্রহ করা হয় স্টেমসেল। তারপর এই কোষগুলোকে হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয় এবং ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। পরে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার ঠিক আগে ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে আলাদা করে সরিয়ে নেয়া হয়।
অপর একটি প্রক্রিয়ায় ব্লাড ক্যান্সারের রোগী চিকিৎসা করা হয়। ওই প্রক্রিয়ার নাম অ্যালোজেনিক। ওই প্রক্রিয়ায় রক্তের সাথে মিলে অন্য একজন ব্যক্তির কাছ থেকে সুস্থ বোনম্যারো সংগ্রহ করা হয়। তবে এই প্রক্রিয়া একটু বেশি জটিল বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা: এম এ খান। তিনি জানান, বিশ্বের প্রতিটি সেন্টারই অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্ল্যান্টে কিছুটা সময় নিয়ে থাকে, এটা জটিল বলে।
তবে আমরা অটোলোগাস প্রক্রিয়ায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিষয়ে প্রশিক্ষিত। বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এই সেন্টারকে সব ধরনের সহায়তা করে যাচ্ছে। আমরাও প্রতিটি মুহূর্তে তাদের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। অধ্যাপক এম এ খান বলেন, বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের সফলতা খুবই ভালো। বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টে সারা বিশ্বেই ৯০ শতাংশ সফলতা রয়েছে। এ চিকিৎসায় রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট চালু হয়েছে ২০১৮ সালে। স্থাপনের পর বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র একজন রোগীর চিকিৎসা করেছে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু করে। তাদের প্রথম রোগী কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীর ইফতি আরা (৪৮)। ১৮ দিন পর তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
বেসরকারি অ্যাপোলো হাসপাতালও শুরু করেছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৮ জুন দ্বিতীয় ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে হাসপাতালটি। অ্যাপোলোও অটোলোগাস পদ্ধতিতে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে। ঢাকা মেডিক্যালের সেন্টারটি পুরোপুরি চালু না হওয়ায় এখানো অনেক রোগী বিদেশে চলে যাচ্ছে।
সুত্রঃ নয়া দিগন্ত
Leave a Reply