শ্যামল সরকারঃ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর, আলসামসের কোনো তালিকা প্রকাশ হচ্ছে না। আদৌ এ ধরনের কোনো তালিকা ভবিষ্যতে প্রকাশ হবে কি না, তা-ও অনিশ্চিত। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে ঘোষণা করলেও এখন তা আর কার্যকর হচ্ছে না।
জানতে চাইলে মন্ত্রী ঐ খবরের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘এক্ষুনি আর স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে না। আরো যাচাই-বাছাই এবং তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হবে।’গত ১৫ ডিসেম্বর রাজাকারের তালিকা বলে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নাম প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত ঐ তালিকায় অনেক শহিদ মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার নামও প্রকাশ পায়। বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে সর্বমহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। আন্দোলন-সংগ্রামও শুরু হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐ তালিকা স্থগিত করার নির্দেশ দেন। তালিকাটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সে সময় মন্ত্রী বলেছিলেন, ২৬ মার্চ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ হবেই। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বা রাজাকার, আলবদর, আলসামসের তালিকা প্রকাশ করা এখন খুবই জটিল রাজনৈতিক বিষয়। এখন বেশির ভাগ রাজাকারই বেঁচে নেই। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের সন্তান, আত্মীয়স্বজন আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গসংগঠনের মধ্যে বেশ শক্তিশালী অবস্থানও করে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তান বাহিনীর দালালি করেছিল, তাদের একটি গেজেট সে সময় করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ট্রাইব্যুনালে তাদের বিরুদ্ধে দালাল আইনে মামলাও হয়েছিল। পাশাপাশি এমন অনেকেই ছিলেন, যারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন আবার মুক্তিযোদ্ধাদেরও তথ্য দিতেন। পারস্পরিক বিরোধের কারণে সে সময় অনেক আওয়ামী লীগ নেতার নামেও থানায় দালাল আইনে মামলা হয়। সেসব ব্যক্তির নামও ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় চলে আসে। ১৯৭০ সালের উপনির্বাচনে যেসব ব্যক্তিকে এমপিএ বা এমএনএ নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল, তারাও রাজাকার বলে উল্লেখ করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে বিব্রত সরকার শেষমেশ তালিকা স্থগিত করে দেয়। সূত্র বলছে, এখন যা পরিস্থিতি, তাতে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করাটা প্রায় অসম্ভব। সব জেলা প্রশাসকের কাছে রাজাকারের তালিকা পাঠানোর একাধিক নির্দেশ এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। মাত্র ৯টি বিভাগ বা জেলা থেকে কার্যত মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন যশোরের শার্শা উপজেলায় একজনও রাজাকার নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে দালাল আইনে প্রায় ৫৫ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু কিছু ব্যক্তিকে (যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণ, খুন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ গুরুতর অভিযোগ ছিল না) সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দিয়েছিলেন। প্রায় এক দশক আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর রাজাকারের তালিকা তৈরির দাবি জোরালো হয়। ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, রাজাকারের কোনো তালিকা সরকারের কাছে নেই। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বরাবরই রাজাকারের তালিকা প্রকাশের দাবি করে আসছে। ১৯৭১ সালে খুলনায় আনসার হেডকোয়ার্টার্সে পাওয়া তালিকায় ৩০ হাজারের বেশি রাজাকারের তথ্য মিলেছিল। ঐ তালিকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রয়েছে। গত ২৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। ১৯৭১ সালে থানা থেকে বেতনভোগী রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহের জন্য গত বছরের ২১ মে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে চিঠি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। পরে ঐ তালিকা করার জন্য আবারও তাগিদ দেওয়া হয়। কমিটির সভাপতি শাজাহান খান সে সময় সাংবাদিকদের বলেন, তালিকা হাতে আসা শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় অনেক নথি সুকৌশলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে পূর্ণ তালিকা পাওয়া কঠিন হচ্ছে। তত্কালীন ১৯ জেলার রেকর্ডরুমে যেসব দালিলিক প্রমাণ ছিল, সেগুলো দিতে বলা হয়েছিল; তবে আশানুরূপ তালিকা পাওয়া যাচ্ছে না।’
Leave a Reply