স্টাফ রিপোর্টারঃ করোনা পরিস্থিতির কারণে চাপা পড়ে গেল হবিগঞ্জবাসীর স্বপ্নের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের লুটপাটের বিষয়টি। সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বারবার দাবি উঠলেও সংশ্লীষ্টরা বলছেন- করোনার কারণে বন্ধ আছে তদন্ত। তবে সাধারণ মানুষ বলছেন- যে অবস্থাই আসোক না কেন হবিগঞ্জবাসীর হৃদয়ের স্পন্দন শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ নিয়ে যারা লুটপাটে মেতেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়। এদিকে, হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের লুটপাটকারীদের অপসারণ করে অনতিবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) হবিগঞ্জ জেলার নেতৃবৃন্দ। গতকাল রোববার দুপুরে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সামনে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।
জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড পীযুষ চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- সিপিবি নেতা চৌধুরী মহিবুন্নুর ইমরান, আজমান আহমেদ, সামছু মিয়া, আহাদ, মিয়া, রনজিত সরকার প্রমুখ।
কর্মসূচির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন- জেলা উদীচীর সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান কাউছার, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির নেতা এড. রনধীর দাশ, কাজল মিয়া, বিষ্ণু সরকার, জন্টু সরকার, সেলিম মিয়া, আলী হোসেন, মনজিল মিয়া ও রফিকুল ইসলাম।
জানা যায়, হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেলের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বইপত্র, সাময়িকী, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য ২০১৮ সালে আহবান করা হয় দরপত্র। এ লক্ষে কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ান স্বাক্ষরিত আদেশে ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. মো. শাহীন ভূইয়াকে সভাপতি করে গঠন করা হয় ৩ সদস্য বিশিষ্ট বাজার দর যাচাই-বাছাই কমিটি। দরপত্রে অংশ নেয় ৭টি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মূল্যায়ন রিপোর্টে সদস্যদের স্বাক্ষর ছাড়াই অদৃশ্য হাতের ইশারায় ঢাকার শ্যামলী এলাকার বিশ্বাস কুঞ্জছোঁয়া ভবনের ‘নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ’ ও মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের ‘পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে মালামাল সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়।
এর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ভ্যাট ও আয়কর খাতে সরকারি কোষাগারে জমা হয় ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা ৯৭ হাজার ৭শ’ ৪৮ টাকা। মালামাল ক্রয় বাবত ব্যায় দেখানো হয় ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার ১শ’ ৯ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ওই মালামালের মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি নয়, এমনটাই দাবি করেন দরপত্র প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। বাকি টাকার পুরোটাই হয়েছে ভাগ-বাটোয়ারা।
সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে ৬৭টি লেনেভো ল্যাপটপের (মডেল ১১০ কোর আই ফাইভ, কিং জেনারেশন) মূল্য নেয়া হয় ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫শ’ টাকা। প্রতিটির মূল্য পড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা। অথচ ঢাকার কম্পিউটার সামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ফ্লোরায় একই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪২ হাজার টাকায়। ৬০ হাজার টাকা মূল্যের এইচপি কালার প্রিন্টার (মডেল জেড প্রো এম ৪৫২এন ডব্লিউ)-এর দাম নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯শ’ টাকা। ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় হয়েছে ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। জনপ্রতি চেয়ার-টেবিল ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যয় পড়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ’ টাকা। চেয়ারগুলোতে ‘ইয়ামিন ফার্নিচার’ লেখা থাকলেও টেবিলগুলো কোন প্রতিষ্ঠানের এর কোনো স্টিকার লাগানো নেই।
দেশের নামিদামি ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে এসব চেয়ারের মূল্য ওই দামের অর্ধেকের চেয়েও কম। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত সাধারণ মানের ১৫টি বুক সেলফের মূল্য ৬ লাখ ৬০ হাজার, ৫টি স্টিলের আলমিরা ২ লাখ ৮৫ হাজার, ১০টি স্টিলের ফাইল কেবিনেট ৪ লাখ ২২ হাজার, ২৫টি স্টিলের র্যাক ১৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ও ৬৪৭৫টি বইয়ের জন্য বিলে দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬শ’ ৬৪ টাকা। এছাড়াও বিলে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ১০৪টি প্লাস্টিকের মডেলের মূল্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৩ টাকা দেখানো হয়। এছাড়া দেশের বাজারে ‘পেডিয়াটিক সার্জারি’ (২ ভলিয়মের সেট) বইটির দাম ৩৩ হাজার টাকা হলেও নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ দাম নিয়েছে ৭০ হাজার ৫শ’ ৫০ টাকা।
এদিকে, মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করেছে। যার মূল্য নিয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩শ’ ২৫ টাকা। অথচ এর বাজার মূল্য ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩শ’ টাকা। পুনম ইন্টারন্যাশনাল এসি’র দাম ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দরে ৩১টির মূল্য নিয়েছে ৬১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ওয়ালটনের যে মডেলের ফ্রিজ ৩৯ হাজার ৩শ’ ৯০ টাকা, একই কোম্পানি ও একই মডেলের ফ্রিজের মূল্য গুনতে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। এ রকম ৬টি ফ্রিজ কেনা হয়। ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল ওয়েইং (ওজন মাপার যন্ত্র) মেশিনের দাম নেয়া হয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাস্তবে যার বাজার মূল্য ৪০ হাজার টাকা করে। এছাড়া মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ছবি সংবলিত কাগজে ছাপা চার্ট বাজারে ১শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় পাওয়া গেলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি চার্ট কিনেছে ৭ হাজার ৮শ’ টাকা দরে। এ রকম ৪৫০টি চার্ট ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ৩৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। দেশে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় পাওয়া যায় ‘স্টারবোর্ড‘ নামে হিটাচি কোম্পানির ৭৯ ইঞ্চির ইন্টারেক্টিভ বোর্ড। কিন্তু একই কোম্পানি ও মডেলের এই ইন্টারেক্টিভ বোর্ডটি কেনা হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়।
এমন অবিস্বাস্য দূর্নীতির বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা হলে নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত বছরের ২ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যান বিভাগের যুগ্ম সচিব (নির্মাণ ও মেরামত অধিশাখা) মো. আজম খানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্ত শেষে কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে। এছাড়া অনুসন্ধানে নামে বাংলাদেশ দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর দুদকের একটি টিম সরেজমিন তদন্ত করে।
Leave a Reply