নিজস্ব সংবাদদাতা : চেম্বারের দরজা খুলেই আঁতকে উঠলেন দাঁতের চিকিৎক ডা: মোহাম্মদ শাহিবুল হক। ডেন্টাল ইউনিটের ফ্লোর ভেসে গেছে রক্তে। নিথর পড়ে রয়েছে সহকারি মাইনুল মীরের (২৩) দেহ। সেই দরজা খোলার পর্ব থেকেই যেন ঝাঁপি খোলার মতো মাত্র তিন ঘন্টার ব্যবধানে পুলিশ বের করে নিয়ে এসেছে শ্বাসরুদ্ধকর ও লোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য।
নিহত মাইনুল মীর নরসিংদীর ঘোড়াশাল থানার দক্ষিন চর পাড়া গ্রামের মৃত ফেলু মিয়ার ছেলে। স্থানীয় মুসা বিন কলেজ থেকে এবার দিয়েছিলেন এইচএসসি পরীক্ষা। যার ফল ঘোষণার কথা আজ রোববার। হত্যাকাণ্ডটি হার মানিয়েছে থ্রিলার মুভির কাহিনীকেও। মাত্র ৩ ঘন্টার ব্যবধানে এই ঘটনার রহস্যের জাল ভেদ করে ঘাতক হিসেবে বেরিয়ে এসেছে নিহতের সাবেক প্রেমিকা। তার ভাবলেশহীন শান্ত মেজাজ-মর্জিতেই চোখ কপালে উঠেছে পুলিশের।
নিখুঁত ছক, সুচারু পরিকল্পনা আর ঘাতকের একের পর এক পদক্ষেপ হার মানিয়েছে পেশাদার খুনির আচরণকেও। লোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে নিহতের একসময়ের প্রেমিকা ইসরাত জাহান মিম (১৯) কে।
মিম ঘোড়াশালের শীলপাড়া গ্রামের ইমরান হোসেনের মেয়ে। সে নিজেও মুসা বিন কলেজ থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
প্রথমে ভাবলেশহীন চেহারায় পুলিশকে বোকা বানালেও শেষ পর্যন্ত তদন্তকারীদের কৌশলের কাছে হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার আদ্যোপান্ত স্বীকার করেছে মিম। একই স্কুল এবং কলেজে একসাথে লেখাপড়া করার সুবাদে মাইনুল এবং মিমের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের।
উভয়েই দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় বাড়তি আয়ের জন্য মাইনুল ঘোড়াশাল বাজার “টুথ অফিস” নামের একটি ডেন্টাল চেম্বারে সহকারীর কাজ নেয়। অন্যদিকে মিম মেডিকেল এ্যাসিসটেন্ট হিসেবেও কাজ নেয় স্থানীয় একটি ক্লিনিকে। এর মধ্যে মিম ভালবেসে গোপনে এক ছেলেকে বিয়েও করে এবং তাকে ডিভোর্স দেবার পর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব থেকে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে গড়াতে থাকে মাইনুলের সাথে।
পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইলিয়াছ জানান, ভৈরব থেকে সপ্তাহে দু’দিন প্র্যাকটিস করতে ঘোড়াশালে আসতেন ডেন্টাল চিকিৎসক শিহাবুল হক। অবশিষ্ট সময়গুলোতে এই চেম্বারের নিয়ন্ত্রণ থাকতো মাইনুলের হাতে।
তিনি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি এই চেম্বারটি ছিল মূলত মিম এবং মাইনুলের অবাধে মেলামেশা নিরাপদ স্থান। গত ৬ ফেব্রুয়ারি মাইনুল ভালবেসে গোপনে বিয়ে করেন নরসিংদী সদরের বাসিন্দা শ্রাবন্তী (২০) নামের এক তরুণীকে। শ্রাবন্তী নিজেও এবার এইসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। খবর পেয়ে পরদিন শ্রাবন্তীর বাবা, খালু এবং ভগ্নিপতি ছুটে আসেন মাইনুলের বাড়িতে। তারা শ্রাবন্তীকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও শ্রাবন্তী যাননি। এদিকে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ডেন্টাল চেম্বারে যাবার কথা বলে নিখোঁজ হন মাইনুল।
এ ব্যাপারে শ্রাবন্তী পলাশ থানায় গিয়ে তার স্বামীর নিখোঁজের বিষয়ে বাবা, খালু এবং ভগ্নিপতির দিকে সন্দেহের আগুন তুলে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। শুরু হয় তদন্ত। তবে এ পর্যায়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ক্লু না পেয়ে পুলিশ সহযোগিতা নেয় তথ্যপ্রযুক্তির। কল ডিটেইলস ঘেঁটে পুলিশ জানতে পারে, নিখোঁজ হবার আগে সর্বশেষ মাইনুলের সাথে কথা হয় মিমের। তারপর থেকেই বন্ধ হয়ে যায় মাইনুলের মোবাইল ফোনের সুইচ। তবে মাইনুল যেখানে সহকারী হিসেবে কাজ করতো সেই ডেন্টাল চেম্বারের বাইরে থেকে তালা সাঁটানো থাকায় ধন্দে পড়ে যায় মাইনুলের সন্ধানে থাকা তার স্বজন এবং তদন্তকারীরা।
শনিবার বিকেল তিনটার দিকে ভৈরব থেকে নিজের চেম্বার করতে এসে তালা খুলতেই হতচকিত হন ডেন্টাল চিকিৎসক শিহাবুল হক। যাকে মোবাইলে লাগাতার মোবাইলে ফোন কেরেও পাচ্ছিলেন না চোঁখের সামনে তার রক্তাক্ত নিথঁর দেহ দেখে তাৎক্ষণিক তিনি জরুরী সেবা ৯৯৯ এ ফোন করলে ছুটে আসে পুলিশ। খোঁজ মেলে মাইনুলের। নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজিম জানান, ইত্যবসরে তদন্ত থাকা পুলিশ ওই বাজারের আশে পাশের সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারে মাইনুল নিখোঁজের আগে তারা ওই চেম্বার একসাথে ঢুকেছিল।
পুলিশ সুপার জানান, এবার সন্দেহের দৃষ্টি-সীমায় চলে আসে মিম। অভিযান চালিয়ে এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে আটক করার পর মিমের ভাবলেশহীন, ‘নিষ্পা’ বয়ান ধাঁধাঁয় ফেলে দেয় ফেলে দেয় তদন্তকারীদের। তবে বেশ কিছু আলামত আর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তাকে দেখানোর পর ধীরে ধীরে হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত তদন্তকারীদের সামনে স্বীকার করে মিম। জিজ্ঞাসাবাদে মিম বলেছে, গোপনে বিয়ে এবং স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার পর ক্রমেই মাইনুলের প্রতি তার নির্ভরতা বেড়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার সকালে দুজনের দেখা হয় ঘোড়াশাল বাজারে। মাইনুল মিমকে জানিয়ে দেয়, সে সদ্য বিয়ে করেছে। এখন আগের মত আর মেলামেশা করা সম্ভব নয়। এতেই ক্রোধে জ্বলে উঠে মিম। বিকেলে ডেন্টাল চেম্বারে দেখা করার কথা বলে ঠান্ডা মাথায় বিদায় নিয়ে নেয় মিম। এর মধ্যে স্থানীয় একটি ফার্মেসি থেকে চেতনানাশক ইনজেকশন কিনে গোপনে ব্যাগে নিয়ে চলে যায় চেম্বারে। সেখানে মাইনুলের বিয়ের প্রসঙ্গটি তুলতেই শুরু হয় দুজনের ঝগড়া। এক পর্যায়ে পলাশ থানার ওসি ইলিয়াস, তিনি জানান সামান্য এইচএসসি পরিক্ষার্থী এতটা সুনিপুণভাবে একটি হত্যাকাণ্ড সংগঠনের পরপর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে এবং পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ভাবলেশহীন চেহারায় পুলিশকে-ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করবে সব মিলিয়ে মেয়েটির আচরণ হার মানিয়ে দিয়েছে পেশাদার খুনির আচরণকেও। এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের বেশ কিছু আলামত উদ্ধারের জন্য অভিযান চলছিল। মাইনুল নীরবতা অবলম্বন করলে মিম পেছন থেকে গিয়ে তার ঘাড়ে চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করে দেয়। কিংকর্তব্য বিমুঢ় মাইনুল দ্রুত ওয়াশ রুমে ঢুকে মুখ ধুয়ে বের হতে না হতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এসময় চেম্বারে থাকা ছুরি দিয়ে সংজ্ঞাহীন মাইনুলের ঘাড়ে একের পর এক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করা হয় তাকে। এক পর্যায়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে মাইনুলের মোবাইল নিয়ে মিম বাইরে থেকে তালা মেরে ফিরে যান নিজের বাড়িতে। ফেরার পথে চেম্বারের চাবিটি একটি ড্রেনে এবং মাইনুলের মোবাইলটি পেছনের শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয় মিম। ঘটনাস্থলে থাকা নরসিংদী পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আলম জানান, মাত্র ৩ ঘন্টার ব্যবধানে পুলিশ মাইনুল নিখোঁজ এবং হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে এবং প্রকৃত অপরাধীকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে।
Leave a Reply